প্রথম মুক্তাঞ্চলের স্বীকৃতি মেলেনি এখনো-রেদ্বওয়ান মাহমুদ

Spread the love

[প্রিয় পাঠক,
আজ ২১ নভেম্বর, জকিগঞ্জ মুক্তাঞ্চল দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে সীমান্তবর্তী এ জনপদ শত্রুমুক্ত হয়। জকিগঞ্জকে প্রথম মুক্তাঞ্চল হিসাবে স্বীকৃতির দাবি নিয়ে পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লেখালেখি করেছিলেন জকিগঞ্জ টিভির জনপ্রিয় উপস্থাপক, প্রয়াত রেদ্বওয়ান মাহমুদ চৌধুরী।

এই তাৎপর্যপূর্ণ দিনে তাঁর সেই লেখাটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো।]

প্রথম মুক্তাঞ্চলের স্বীকৃতি মেলেনি এখনো

-রেদ্বওয়ান মাহমুদ

আজ ২১ নভেম্বর। জকিগঞ্জ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে প্রথম মুক্তাঞ্চল সিলেটের জকিগঞ্জ দিয়ে শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা। তবে জকিগঞ্জকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম মুক্তাঞ্চলের স্বীকৃতি দিতে যুগ যুগ ধরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ জকিগঞ্জবাসী দাবি জানালেও তা আলোর মুখ দেখেনি। আজও মেলেনি স্বীকৃতি। প্রত্যেক বছর ২১ নভেম্বর স্থানীয়ভাবে দিনটি উদযাপন করা হয় স্বীকৃতির আক্ষেপ নিয়ে।

১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে জকিগঞ্জে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পিত অভিযানে ঈদের দিন সন্ধ্যার পূর্বেই পাক হানাদার বাহিনী পরাজয় বরণ করে। ফলে শত্রুমুক্ত হয় জকিগঞ্জ, আর মুক্ত বাতাসে পতপত করে উড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্য অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর ঈদের দিন রাতে যৌথ বাহিনীর এক সাঁড়াশি অভিযানের ফলে ২১ নভেম্বর ভোরে মুক্ত হয় সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জ। যুদ্ধের সময় এই অঞ্চল ছিল ৪ নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। মেজর চিত্ত রঞ্জন দত্তের অধিনায়কত্বে এই সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা ছিলেন প্রয়াত সাবেক মন্ত্রী, এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। ৬টি সাব সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মাহবুব রব সাদী, লেফটেন্যান্ট জহির উদ্দিন ও ক্যাপ্টেন এম এ রব। একাত্তরে পাক হানাদার কর্তৃক অত্যাচারের মাত্রা যখন ক্রমশ বাড়ছে তখন প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী ১১টি সেক্টরেই আক্রমণের তীব্রতা বাড়ানোর নির্দেশ দেন। খবর আসে ৪নং সেক্টরেও। জকিগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে বৈঠকে বসেন মুক্তিযোদ্ধারা। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে শুরু হয় আক্রমণের প্রস্তুতি।

২০ নভেম্বর গভীর রাত। জন্মমাটিকে স্বাধীনতার সুভাষ এনে দিতে জীবন বাজি রেখে শুরু হয় অপারেশন। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ৩টি দলের সমন্বয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু। প্রথম দল লোহার মহল, দ্বিতীয় দল আমলসীদ এবং মূল দল জকিগঞ্জের কাস্টমস ঘাট বরাবর করিমগঞ্জ কাস্টমস ঘাটে অবস্থান নেন। প্রথম ও দ্বিতীয় দল নিজ নিজ অবস্থান থেকে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে জকিগঞ্জের দিকে অগ্রসর হলে পাক বাহিনী টের পেয়ে যায়, শুরু হয় ছুটাছুটি। মূলত এই দুটি দল দুই দিক থেকে পাক বাহিনীর সদস্যদের ব্যস্ত করে রাখে। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ভেবে তারা আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়ক দিয়ে পালাতে থাকে। এর মধ্যেই প্রথম ও দ্বিতীয় দল জকিগঞ্জ পৌঁছে যায়। আর এদিকে মূল দল রাবারের বালিশ দিয়ে সেতু তৈরি করে কুশিয়ারা নদী পার হয়ে প্রবেশ করে জকিগঞ্জ শহরে। নদী পার হয়ে তীরে উঠতেই লুকিয়ে থাকা এক পাক সেনার বুলেটে প্রাণ হারান ভারতীয় বাহিনীর মেজর চমন লাল ও তার দুই সহযোগী। তবে মুক্তিবাহিনীর সমর দক্ষতায় হার মেনে আটক হয় ৭-৮ জন শত্রুবাহিনীর সদস্য। প্রধান ডাকঘরের দোতলা থেকে ভারী মেশিনসহ বন্দি করা হয় এক সেনা অফিসারকে। অতঃপর শোষকের নাগপাশ ছিন্ন করে বিজয় হাতের মুঠোয় পুরে বীরের বেশে ফিরেন মুক্তিযোদ্ধারা। এভাবেই প্রথম মুক্তাঞ্চল জকিগঞ্জ দিয়ে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা।

২১ নভেম্বর ঊষালগ্নে শ্লোগান দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে স্বাগত জানান জকিগঞ্জবাসী। দীর্ঘ আট মাস পর স্বজনদের কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হন মুক্তিযোদ্ধারা। পরদিন ২২ নভেম্বর আব্দুল লতিফ এমসিএ, ইসমত আহমদ চৌধুরী, আব্দুল মঈদ চৌধুরী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ কুশিয়ারা পার হয়ে জকিগঞ্জে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয় জকিগঞ্জে স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী লড়াই।

জকিগঞ্জকে দেশের প্রথম মুক্তাঞ্চল রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণার দাবি জানিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফোরামে বিষয়টি উত্থাপিত হলেও কোনো ফল মেলেনি। প্রথম মুক্তাঞ্চল রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ২০১২ সালে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনে ২১ নভেম্বর জকিগঞ্জ প্রথম মুক্তাঞ্চল বাস্তবায়ন পরিষদ গঠন করা হয়। কিন্তু এত বছর পরও হয়নি কাজের কাজ। দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির জন্য স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, প্রবাসী ঐক্য পরিষদ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ জকিগঞ্জের প্রতিটি মানুষের দাবি দীর্ঘদিনের। জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা অন্তত জীবদ্দশায় যেন নিতে পারেন স্বীকৃতির স্বাদ।


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *